ডেস্ক সংবাদ : দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদকে খবর সংগ্রহে যেতে যেতে দুর্নীতির বরপুত্র হয়ে উঠেছেন ডিবিসি নিউজের বিশেষ প্রতিনিধি আদিত্য আরাফাত। ঢাকায় কিনেছেন দুটি আলিশান ফ্ল্যাট। একেকটির দাম ৮৬ লাখ টাকা। চড়েন দামি প্রাইভেট কারে। গাজীপুরে একটি রিসোর্টের অংশীদার। জমি কিনেছেন প্রায় ৩০ বিঘা। এই সব সম্পত্তির মালিক হয়েছেন ২০১২ সালের পর থেকে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির’ সাজা আদিত্য আরাফাত বাস্তব জীবনে টাকা আর ক্ষমতার নেশায় উন্মত্ত। নিজেকে ছাপোষা সাংবাদিক হিসেবে জাহির করলেও তার পরতে পরতে দুর্নীতির দুর্গন্ধ। ‘চোথা সাংবাদিকতা’ করে গত এক যুগে অবৈধভাবে অন্তত ৫০ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন আদিত্য আরাফাত।
সংবাদপত্র, টেলিভিশন স্টেশন ও অনলাইন সংবাদপত্রে কাজ করা ২৮ সাংবাদিকের ব্যাংকে কত টাকা আছে, তারা কী পরিমাণ লেনদেন করেছেন- অতি সম্প্রতি সেসব তথ্য জানতে চেয়েছে কেন্দ্রীয় আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-বিএফআইইউ।
এই আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি পাওয়ার পর, বিএফআইইউ সাংবাদিকদের হিসাবের তথ্য জানতে চেয়ে ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়েছে। তালিকায় ২৩ নম্বরে রয়েছেন আদিত্য আরাফাত। এছাড়াও ডিবিসি নিউজের আরও দুজনের নাম রয়েছে। তারা হলেন- জায়েদুল হাসান পিন্টু ও মাসুদ আইয়ুব কার্জন।
চিঠিতে বলা হয়েছে, এই ২৮ সাংবাদিকের ব্যাংক লেনদেনের পাশাপাশি তাদের নামে ব্যাংকের লকার, সঞ্চয়পত্র, ক্রেডিট কার্ডসহ অন্যান্য কোনো আর্থিক উপকরণ রয়েছে কি না সে তথ্যও বিএফআইইউকে জানাতে হবে।
আদিত্য আরাফাতের জন্ম ১৯৮৬ সালের পহেলা জানুয়ারি। তার প্রকৃত নাম মুহাম্মদ আরাফাতুল মোমেন। ২০১০-১১ সালে সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরীর মাধ্যমে চাকরি নেন অনলাইন সংবাদপত্র বাংলানিউজ-এ। ফেনীর মালীপুর থেকে ঢাকায় এসে বাবা-মায়ের দেয়া নাম পরিবর্তন করে হয়ে যান ‘আদিত্য আরাফাত’।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের তালিকা প্রকাশ্যে আসার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিকটিম কার্ড শো করে সহানুভূতি নেয়ার চেষ্টা করছেন আদিত্য আরাফাত। ঘনিষ্ঠ মহলে ‘ধূর্ত খেকশিয়াল’ হিসেবে পরিচিত এই দুর্নীতিবাজ সাংবাদিক লোক ভাড়া করে নিজের পক্ষে ক্যাম্পেইনও চালাচ্ছেন। তথ্য মন্ত্রণালয়ের তালিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে মরিয়া আদিত্য ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা।
২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দুদকের কমিশনার ছিলেন মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। এই সময়ে আদিত্য আরাফাতের নাটকীয় উত্থান। চুপ্পুর আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে গড়ে তোলেন সংঘবদ্ধ চক্র। এই চক্রে সাংবাদিক ছাড়াও দুদকের বেশ কিছু কর্মকর্তা জড়িত। এ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল দুদকের এক উপ-পরিচালক জানান, “বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের বিশেষ করে যারা বিএনপিপন্থী তাদের টার্গেট করে অভিযোগ জমা দিতো আদিত্য আরাফাতসহ আরও কয়েকজন সাংবাদিক। পরে চক্রে থাকা দুদকের লোকজন চিঠি ইস্যু করতেন। এরপর ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন আদিত্য আরাফাতসহ অন্য সাংবাদিকরা। ভয়-ভীতি দেখিয়ে আদায় করতেন মোটা অঙ্কের টাকা। পরে তা চক্রের সবাই ভাগাভাগি করে নিতেন। এই পুরো জিনিসটাই জানতেন চুপ্পু স্যার।”
সংঘবদ্ধ চক্র গড়ে অর্থ হাতিয়ে নেয়াতে হাত পাকিয়ে বাংলানিউজ ছেড়ে ২০১৬ সালের পহেলা মে ডিবিসি নিউজে যোগ দেন আদিত্য আরাফাত। এবারও চাকরি নেন ইকবাল সোবহান চৌধুরীর মাধ্যমে। উল্লেখ্য ইকবাল সোবহান চৌধুরী ডিবিসি নিউজের চেয়ারম্যান।
ডিবিসি নিউজে যোগদানের পর আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে আদিত্য সিন্ডিকেট। প্রতি মাসেই ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করে অর্থ হাতিয়ে নিতে থাকেন আদিত্য আরাফাত। এছাড়াও এবি ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, পারটেক্স গ্রুপ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ট্রাস্টিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে ব্ল্যাকমেইল করে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। যা অব্যাহত থাকে শেখ হাসিনা সরকার পতনের আগে পর্যন্ত।
২০২৪ সালের আগে পর্যন্ত দুদক বিটে কর্মরত সাংবাদিকদের একমাত্র সংগঠন ছিল রিপোর্টার্স এগেইনস্ট করাপশন- র্যাক। কিন্তু নিজের একচ্ছত্র প্রভাব ধরে রাখতে নিজস্ব ঘরানার সাংবাদিকদের নিয়ে চলতি বছরের দোসরা জানুয়ারি আরেকটি সংগঠনের জন্ম দেন আদিত্য আরাফাত। অ্যান্টি করাপশন রিপোর্টার্স ফোরাম- এসিআরএফ নামের এই সংগঠনে রয়েছেন আদিত্য-ঘনিষ্ঠ রিপোর্টার এটিএন নিউজের তাওহীদ সৌরভ, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের রিশাদ হুদা, ডেইলি সানের মোর্শেদ নোমান, ঢাকা পোস্টের এম এ রহমান মাসুম, কালের কণ্ঠের হাসিব বিন শাহিদ, এটিএন বাংলার মাহবুব কবির চপল ও বাংলাবার্তার শেখ জাহিদুজ্জামান। প্রতিষ্ঠার দিনে এসিআরএফ-কে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সংগঠন বলে ঘোষণা দেন আদিত্য আরাফাত।
আদিত্য আরাফাতের সংগঠন এসিআরএফ-এর দুর্নীতিতে সহযোগিতা করেন অতি সম্প্রতি পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়া দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ ও দুই কমিশনার মো. জহুরুল হক ও মোছা. আছিয়া খাতুন। এই তিন কর্মকর্তাই হাসিনা সরকারের সুবিধাভোগী।
২০২৪ সালে হাসিনা সরকারের সুপারিশে সাংবাদিক কোটায় যে ১০ সাংবাদিক হজ পালন করেন তাদের মধ্যে ছিলেন আদিত্য আরাফাতও। যদিও ব্যাংক হিসাব তলব করার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ধূর্ত সাংবাদিক দাবি করছেন, তিনি কখনও রাজনৈতিক সুবিধা নেননি!
হাসিনার পতনের পর ডিবিসি নিউজের শেয়ার কেনার জন্য দেনদরবার করছেন আদিত্য আরাফাত। ইতোমধ্যে ডিবিসি নিউজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহীদুল আহসানের সঙ্গে দুই ব্যবসায়ীর দেখা করার ব্যবস্থা করেছেন তিনি। শহীদুল আহসানের ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, ওই দুই ব্যবসায়ীকে সামনে রেখে আসলে শেয়ার কেনার চেষ্টা করছেন হাসিনার তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরীর আশীর্বাদপুষ্ট আদিত্য। শেয়ার কিনতে পারলে ডিবিসি নিউজের পলাতক সিইও মঞ্জুরুল ইসলামের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার ইচ্ছার কথা ঘনিষ্ঠ মহলে প্রকাশ করেছেন তিনি। আদিত্যর এক আত্মীয় জানান, “ডিবিসি ছাড়াও আরও কয়েকটি টিভি চ্যানেলের সঙ্গেও একই প্রক্রিয়ায় আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন উনি। কোনো না কোনোটাতে হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।”
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে দুদকের ভয়-ভীতি দেখিয়ে আদিত্য আরাফাত তার স্ত্রীকে ফেনী থেকে ঢাকায় বদলি করে এনেছেন। যদিও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জেলার বাইরে বদলির কোনো সুযোগ নেই।
দুদক বিটে কর্মরত পেশাদার সাংবাদিকরা জানান, আদিত্য আরাফাতকে ঘাটলেই দুর্নীতির মহাকাব্য বেরিয়ে আসবে। এ ধরনের লোকদের কারণেই সাংবাদিকদের মান-মর্যাদা বলে কিছু নেই। আদিত্যকে দুদকে নিষিদ্ধ চেয়ে শিগগিরই চিঠি দেয়া হবে।