বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী আয়ের গুরুত্ব কতটা তা না বললেও চলে।প্রবাসী আয়ে বদলেছে দেশ ও মানুষের ভাগ্য। করোনা মহামারি কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট পরিবর্তিত বিশ্বে এ কথা আরও বেশি মূর্ত। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই ও আগস্ট) বাংলাদেশি প্রবাসীরা দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার করে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। আগস্টে ২ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি।
তাদের এই পাঠানো বিদেশি মুদ্রায় দেশের ক্রমবর্ধমান আমদানি ব্যয় নির্বাহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া রেমিট্যান্সের অভ্যন্তরীণ প্রবাহ বেশি হওয়ায় দেশের বৈদশিক মুদ্রা বাজারে যে অস্থিরতা, তা কাটতে পারে। একইসঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে আমদানি ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমছে। এই মজুত ধরে রাখতেও ভূমিকা রাখছে রেমিট্যান্স।
এর আগে করোনাভাইরাসের ধাক্কায় বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের অর্থনীতি কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে জাতির ওই দুঃসময়েও পাশে দাঁড়িয়েছেন প্রবাসীরা। চাকরি হারানো কিংবা আয় কমে যাওয়া সত্ত্বেও তারা ওই অর্থবছরে (২০২০-২১) ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন, যা এর আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ শতাংশ বেশি এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় দ্বিগুণ।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, বাংলাদেশের জিডিপির ৬ শতাংশ আসে রেমিট্যান্স থেকে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস। ২০২১ সালে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এর তথ্যমতে, অভিবাসী পাঠানোর দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশ ষষ্ঠ এবং রেমিট্যান্স গ্রহণকারী দেশের মধ্যে অষ্টম। একই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালে ৭৪ লাখ বাংলাদেশি প্রবাসী বিদেশে ছিলেন। তবে করোনাপরবর্তী সময়ে অনেক দেশ ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় এই সংখ্যা বর্তমানে আরও বেশি।
দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স ব্যক্তিপর্যায়ে মানুষের জীবনমানও উন্নত করছে। গ্রামে অনেকের বাড়ি দেখলেই বোঝা যায়, ওই বাড়ির কেউ বিদেশে গেছেন। দেশের অনেক গ্রামের চেহারা বদলে দিয়েছে প্রবাসী আয়। প্রবাসীদের ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনার মাধ্যমে হয়ে উঠছে দক্ষ মানবসম্পদ। তবে আমাদের এ আয়ের যারা জোগানদাতা অর্থাৎ প্রবাসীরা- যারা কাজের উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়েছেন, জমিজমা বিক্রি করে পরিবার–পরিজন ছেড়ে সুদূরে বিদেশে থাকছেন- তাদের জন্য যা যা করার কথা সেসব কি করা হচ্ছে?
এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য কাউকে বিজ্ঞানী বা গবেষক হতে হবে না। প্রতিদিনই পত্রিকার পাতা ভরে প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতি হওয়া নির্যাতন, নিপীড়ন, হয়রানির খবর আসে। তারা শুধু প্রবাসে অর্থাৎ বিদেশের মাটিতে এসবের শিকার হন বিষয়টা এমন না যে, দেশের মঙ্গল ও কল্যাণের জন্য তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, শরীরের রক্ত হিম করে মার্কিন ডলার পাঠান- সেই নিজ দেশেই তাদের হয়রানির শিকার হতে হয়। এটা বিমানবন্দরে কিংবা বিমানের টিকিট কেনার জন্য প্রবাসীদের দীর্ঘ লাইন দেখেই বোঝা যায়।
কয়েকটা উদাহরণ থেকে বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে। যেমন- ১. ২০২২ সালের প্রথম আট মাসে (জানুয়ারি-আগস্ট) প্রায় ৪ হাজার প্রবাসী শ্রমিকের মরদেহ দেশে এসেছে। তার মানে হলো প্রতি মাসে ৫০০ প্রবাসী মারা গেছেন। আর তাদের অধিকাংশই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষের এমন অকাল মৃত্যুতে ওইসব পরিবার পড়েছে মহাবিপদে। (ফিন্যান্সিসিয়াল এক্সপ্রেস, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২)।
২. জাতিসংঘের অভিবাসনবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশের প্রতি ১০ জন নারী প্রবাসী শ্রমিকের মধ্যে সাতজন বিদেশে থাকাকালে নির্যাতনের শিকার হন। (ডেইলি স্টার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭)। ৩. জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব দেশ থেকে মানুষ নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ পৌঁছায় এমন শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। এ ছাড়া বাংলাদেশি শ্রমিকদের ইন্দোনেশিয়া, ভানুয়াতু, জ্যামাইকাসহ বিভিন্ন দেশে পাচারও করা হয়।
এ ছাড়া বিদেশে নির্যাতন-শোষণের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও খারাপ কর্মপরিবেশের বিরুদ্ধে কথাও বলতে পারেন না তারা। তাদের এ প্রবাস যাত্রায় সর্বত্র হয়রানি-নিয়োগ, কর্মসংস্থান কিংবা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে।
প্রবাসীদের কল্যাণে যা করতে হবে
তবে এতকিছুর পরও প্রবাসীরা একবারের জন্যও দেশে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করেননি। তারা চিরদিনের মতো দুই হাত ভরে দেশ ও মানুষের কল্যাণে দিয়েই যাচ্ছেন।
১. আমাদের দেশ প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক জনশক্তি বিশ্ববাজারে রপ্তানি করলেও তাদের অধিকাংশই অদক্ষ। ফলে তারা প্রত্যাশিত মজুরি পান না। সম্ভাব্য প্রবাসী শ্রমিকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও কারিগরি জ্ঞান প্রদানের মাধ্যমে বিদেশে পাঠানো গেলে সেখানে তাদের আয় ও জীবনমান দুটোই বাড়বে।
২. প্রবাসীরা বিদেশ ভ্রমণের খরচ জোগান দিতে অধিকাংশ সময়ই তাদের বাড়িঘর বা জমি-জমা নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে কিংবা অনানুষ্ঠানিক খাত থেকে (যেমন গ্রাম্য মহাজন) চড়া সুদে ঋণ নেয়। তবে প্রবাসীদের এটা থেকে মুক্তি দিতে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ও অন্যান্য বেসরকারি ব্যাংক স্বল্প সুদে ঋণদানের মাধ্যমে এগিয়ে আসতে পারে।
একইসঙ্গে বৈধ চ্যানেলে যেন প্রবাসীরা তারা তাদের কষ্টার্জিত টাকা দেশে পাঠায় সে জন্য তাদের উৎসাহিত করা। এ জন্য ব্যাংকিং সেবা তাদের কাছে আরও সহজলভ্য করা এবং রেমিট্যান্সের ওপর সরকারি প্রণোদনাবিষয়ক বিভিন্ন তথ্য সম্পর্কে তাদের আরও বেশি অবহিত করা। এতে দেশের রেমিট্যান্সের অভ্যন্তরীণ প্রবাহও (ইনফ্লো) বাড়বে।
৩. একজন সম্ভাব্য প্রবাসী শ্রমিক বিদেশে গিয়ে কী কাজ করবেন এবং তার বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কেমন হবে সে সম্পর্কে আগে থেকেই তাকে অবহিত করা। এ জন্য সরকার প্রবাসীদের সচেতনতায় এসব বিষয়ে বিভিন্ন সচেতনতা সভা, সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন করতে পারে।
৪. দেশের কিংবা বিদেশের কোনো বিমানবন্দরে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো প্রবাসী যেন কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হয়-তা নিশ্চিত করা।
৫. বিদেশের মাটিতে কোনো বাংলাদেশি শ্রমিক, বিশেষ করে নারী শ্রমিক, প্রতারিত কিংবা নির্যাতনের শিকার হলে সহজে ও দ্রুত যেন সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশি দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে সে ব্যবস্থা করা। এ ক্ষেত্রে বিদেশে বাংলাদেশি মিশনগুলোকে ব্যবহার করা যেতে পারে।
৬. বিভিন্ন দেশে অবৈধ বাংলাদেশি শ্রমিকদের বৈধকরণে মালদ্বীপের দৃষ্টান্ত সামনে রেখে সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা।
৭. মানবপাচার (প্রতিরোধ ও দমন) আইন-২০১২ এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন, ২০১৩ এর যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিরাপদ ও বৈধ অভিবাসন নিশ্চিত করে মানবপাচার ও অবৈধ অভিবাসন রোধ করা। একইসঙ্গে বৈধ উপায়ে যেন আরও বেশি জনশক্তি রপ্তানি করা যায় সে জন্য নতুন নতুন শ্রমবাজারের খোঁজ করা।
লেখক : শিক্ষানবিশ